বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার প্রতিবাদী তিনবন্ধু নির্মল কর্মকার,অশোক পাল ও প্রবীর বর্মন
সময়টা ছিলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর এলাকার মানুষ যখন ভয়ে চুপ তখন প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন কলেজ পড়ুয়া তিন বন্ধু। তারা মিছিল করেন,দেয়ালে দেয়ালে হত্যার বিচার চেয়ে পোস্টার লাগান। প্রতিবাদের কারণে পুলিশের নির্মম নির্যাতন ও ২৯ মাস কারা ভোগ করতে হয় তাদের। সেই সময়ের প্রতিবাদী তরুণ তিনবন্ধু নির্মল কর্মকার,অশোক পাল ও প্রবীর বর্মন বয়স আর অভাবের ভারে নুয়ে পড়েছেন। ৪৭ বছরেও মেলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।
নাটোরের গুরুদাসপুর পৌরসদরের চাঁচকৈড় বাজার এলাকায় বসবাস তিন বন্ধুর। তাঁদের প্রত্যেকের বয়স বর্তমানে ৬৫ পেরিয়েছে। তিনজনের একজন প্রবীর বর্মন, ভাইয়ের ইলেকট্রনিক্সের দোকান দেখভাল করেন তিনি। নির্মল কর্মকারের এক সময় হার্ডওয়্যারের দোকান ছিলো। পুঁজির অভাবে সেটি এখন বন্ধ। আরেক বন্ধু অশোক পালের জীবন চলছে বাসায় বাসায় গান শিখিয়ে। তিনবন্ধু বার্ধক্যসহ শারীরিক নানা সমস্যায় ভুগলেও অর্থের অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না।
প্রবীর বর্মনের দুই মেয়ে,এক ছেলে। তিন সন্তান উচ্চশিক্ষিত হলেও মেলেনি সরকারী চাকরী। নির্মল কর্মকারের এক মেয়ে,দুই ছেলে। মেয়ে এমএ পাস করেছেন। এখনো বেকার। এক ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করে আর পড়েননি। আর ছোট ছেলে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে। অশোক পালের দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ে ব্যবস্থাপনায় অনার্স এমএ করছেন।
তিনবন্ধুর জানান,বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায়। এ সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ ও নির্মম নির্যাতন ও জেলখানায় অন্ধকারে কাটানো জীবনের স্বীকৃতি দেবে। তবে তাদের এ পর্যন্ত তেমন মুল্যায়ন না হলেও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার হচ্ছে,সব খুনির ফাঁসি দেখে মরতে চান তারা।
গত বছর ১৫ আগস্ট উপলক্ষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তমাল হোসেন ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রাসেল প্রতিবাদকারী ওই তিন বন্ধুর বাড়িতে ছুটে যান। তাঁদের উন্নত চিকিৎসার যাবতীয় খরচের আশ্বাস দিলেও ৪৬ বছরে খবর রাখেনি রাষ্ট্র। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা খোঁজ রাখেননি। মেলেনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। তিনবন্ধু যেভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন ঃ
১৯৭৫ সালে তিন বন্ধুই স্থানীয় বিলচলন শহীদ সামসুজ্জোহা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ১৫ আগস্ট বেতারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার দাবি করে তিন বন্ধু দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগিয়ে দেন। পরদিন কলেজের সহপাঠীদের নিয়ে প্রতিবাদ মিছিলও বের করেন। মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়া তিন বন্ধুকে গ্রেপ্তারে বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ। গ্রেফতার এড়াতে তিন মাসের জন্য আত্মগোপনে চলে যান তাঁরা। এরপর ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যার পর আবার প্রকাশ্যে এসে আবারও প্রতিবাদ করেন। ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর পুলিশের হাতে আটক হন তিন বন্ধু। স্বজনদের সামনে পওে থানায় নিয়ে নির্মম নির্যাতন করা হয় তাঁদের। পরদিন নেওয়া হয় নাটোর জেলা কারাগারে। সেখানে ১৫ দিন রাখার পর পাঠানো হয় রাজশাহী কারাগারে।
তিন মাস পর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য অশোক পালকে অর্ন্তবর্তীকালীন জামিন দেন আদালত। কিন্তু পরীক্ষার দিন কেন্দ্র থেকেই তাঁকে আবার আটক করে পুলিশ। জামিন না পাওয়ায় পরীক্ষা দিতে পারেননি প্রবীর বর্মন ও নির্মল কর্মকার।
প্রবীর বর্মন ও নির্মল কর্মকার বলেন, রাজশাহী জেলখানায় বিচারবর্হিভুতভাবে দুই বছর আটকে রাখা হয় তাঁদের। দুই বছরের মাথায় রাজশাহী জেলা জজ আদালতে ছয় মাসের সশ্রম কারাদন্ড হয় তাঁদের। একই সঙ্গে ২০০ টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে দুই মাসের জেল দেওয়া হয়। জমি-গরু বিক্রি করে জরিমানার টাকা পরিশোধ করেছিলেন তাদেও পরিবার।
বিলচলন শহীদ সামসুজ্জোহা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জালালউদ্দিন তিন বন্ধুর ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘আমি ওই সময় কলেজের অধ্যক্ষ ছিলাম। ওরা তিন বন্ধু বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবিতে কলেজসহ আশপাশের দেয়ালে পোস্টার লাগায়, মিছিল করে। পরে পুলিশ এসে তাদের গ্রেপ্তার করে।’
১৯৭৫ সালে গুরুদাসপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মো. ইসমাইল হোসেন শাহ। তিনি জানান, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করে তিন বন্ধুর পুলিশী নির্যাতনের শিকার হওয়া এবং কারাভোগ করার ঘটনাটি তিনিসহ এলাকাবাসী জানতেন।
গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. তমাল হোসেন বলেন, জাতীর জনক বঙ্গবন্ধুর শাহাদৎ বার্ষিকীর দিনটি উপজেলা প্রশাসন যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করবে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদকারী তিন বন্ধুকে জাতীয় দিবসগুলোতে সম্মানের সাথে আমন্ত্রন জানানো হয়। তিন বন্ধুর কর্মকান্ড তুলে ধরে সরকারের উচ্চপর্যায়ে অবহিত করার আশ্বাস দেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ৬:৩৬ অপরাহ্ণ | শনিবার, ১৩ আগস্ট ২০২২
gurudaspurbarta.com | MD. Faruk Hossain