কবি কাজী কাদের নেওয়াজের শিক্ষাগুরুর মর্যাদা কবিতার মতোই এক সময় ছিলো শিক্ষকের সম্মান ও গুরুত্ব। সমাজের কারো কোন সমস্যা হলে সৎপরামর্শ পাবার জন্য ছুটে আসতেন কোন শিক্ষকের কাছে। সে সময় শিক্ষকদের সমাজ পন্ডিত বলে আখ্যা দিত। তাদের দেখা হতো মর্যাদা আর সম্মানের চোখে। সময় পাল্টে গেছে। আজ যাদের টাকা আছে সমাজে তারাই বেশি সম্মানিত। তাহলে ঘটা করে শিক্ষক দিবস পালন অনর্থক।
রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা বর্তমানে বে-সরকারী শিক্ষকদের সমাজের চোখে সম্মান ও অর্থ দুদিক থেকেই হেও করে রেখেছে। বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় শিক্ষক মানেই মাসের ১৫দিন যেতে না যেতেই বেতনের টাকা শেষে আর্থিক বিড়ম্বনা। অর্থকষ্টে থাকা শিক্ষকদের লজ্জা বিসর্জন দিয়ে হাত পাততে হয় সমাজের কোন বিত্তবানদের কাছে। অথবা নিত্যপন্যের দোকানে বাঁকির জন্য ধর্না দিতে। কারন সরকার তাদের যে বেতন নামের অনুদান সহায়তা দেন তা দিয়ে সম্মানের সাথে পারিবারিব ব্যায় নির্বাহ করা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য। শিক্ষকদের টাকা নাই তাই সম্মানও নেই এমন ধারনা সমাজের অধিকাংশের।
আগের মতো বর্তমান সময়েও শিক্ষকদের নানা বিশেষনে আখ্যা দেয়া হয়,যেমন জাতীর বিবেক,জাতীর মেরুদন্ড,জ্ঞানের মশাল,মানুষ গড়ার করিগর ইত্যাদি ইত্যাদি। আগেরযুগে শিক্ষকদের যে বিশেষন দেয়া হতো সেটা ছিলো প্রকৃত বিশেষন। আর বর্তমান সময়ে বিশেষন দেয়া হচ্ছে কম মজুরী দিয়ে বেশি বেশি পরিশ্রম করিয়ে নেবার জন্য ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা মিষ্টি বুলি।
শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষামন্ত্রীগন যত কথা বলেছেন আর নাটক দেখিয়েছেন তাতে তাদের যোগ্যতা,দুরদর্শিতা মেধা,আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা নিয়ে শিক্ষকদের মাঝে ক্ষোভ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান সময়ে শিক্ষকরা রাষ্ট্রের আধুনিক কৃতদাস। দেশে এখনও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিও না পেয়ে শিক্ষকরা বিনাবেতনে কৃতদাসের কাজটি ঠিকই করে চলেছেন। সরকার পদ সৃষ্টি করলেও তৃতীয় শিক্ষকের বেতন তারাই কেন বন্ধ রেখেছেন তা শিক্ষকদের বোধ্যগোম্য নয়। একজন শিক্ষক কতদিন বিনা বেতনে কৃতদাসের মতো পেটে ক্ষুধার যন্ত্রনা সয়ে শিক্ষার আলো দান করতে পারে সে প্রশ্ন জাতীর কাছে?
আবার মন্ত্রী বাহাদুররা মুখে বলেন শিক্ষকদের বেতন হবে সবার থেকে বেশি কিংবা শিক্ষদের জন্য আলাদা (সতন্ত্র) বেতন স্কেল হবে। কিন্তু বেশি বা সতন্ত্র স্কেল দুরের কথা জাতীয় পে-স্কেলে অর্ন্তভুক্ত হতে শিক্ষকদের আন্দোলন নামতে হয়।
শিক্ষকদের উৎসব ভাতা (ঈদ বোনাস) বেতনের চার ভাগের একভাগ। যে বোনাসের টাকা দিয়ে একদিন ভালো খাবার খাওয়া যায় উৎসব পালন করা যায়না। আবার বাড়িভাড়া আর চিকিৎসা ভাতা একত্রে মাত্র ১ হাজার ৫০০ টাকা। বাড়িভাড়ার ১ হাজার টাকাকে বেসরকারী শিক্ষকরা পাটিভাড়া আখ্যা দেন। চিকিৎসা ভাতার ৫শ টাকা দিয়ে ভালোমানের ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশান ফিও হয়না। ওষুধ কেনার প্রশ্নই ওঠেনা।
শিক্ষকরা ভিনগ্রহের বাসিন্দা। সরকারী শিক্ষকরা চাকরী জীবন শেষ করে নিশ্চিত পেনশান সুবিধা পান। কিন্তু বে শিক্ষকরা অবসরে যান ছাতা আর লাঠি হাতে। সরকার যে খন্ডিত ৭৫ মাসের সমপরিমান টাকা দেবার ঘোষনা দিয়েছেন (শিক্ষকদের বেতন থেকে মাসিক কর্তনকৃত অর্থ) তা পেতে বচরের পর বছর অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে চীর বিদায় নিতে হচ্ছে টাকা ছাড়াই। এমনটা কেন হচ্ছে? এমন বৈষম্য নিয়ে আর আর্থিক দৈন্যতা নিয়ে শিক্ষক ক্লাসে গেলে তার মনোযোগ কেমন থাকবে তা সহজেই অনুমেও।
শিক্ষা আর শিক্ষকদের আর্থিক উন্নয়ন ছাড়া দেশের অগ্রগতি অকল্পনীয়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, পেশা হিসেবে শিক্ষকতা বাংলাদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি। এমন বৈষম্যের চিত্র দেখলে পরবর্তি মেধাবী প্রজন্ম শিক্ষকতা পেষায় আসবেনা। এতে জাতী ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
সরকার শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত দাবী প্রতি সুভদৃষ্টি দিলেই কেবল বৈষম্যের অবসান হতে পারে। যেমন-বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, পূর্ণ উৎসব ভাতা ও পূর্ণ পেনশন। এমপিও বঞ্চিত প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক কর্মচারীদের পাশাপাশি অনার্স, মাস্টার্স পাঠদানকারী বেসরকারি কলেজের শিক্ষক, ডিগ্রি কলেজে বিভিন্ন বিষয়ে তৃতীয় শিক্ষকরা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। তাদের কথা ভেবে এমপিওভুক্তকরন সময়ের দাবী।
একদেশে বৈষম্যমুলক সরকারী বে-সরকারী দ্বৈত নীতির শিক্ষা ব্যবস্থা থাকা ঠিক নয়। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন ভাতা ও মর্যাদাগত বৈষম্য শিক্ষা ব্যবস্থায় সংকট সৃষ্টি করেছে। এই সংকট উত্তরণ করে শিক্ষকদের পর্বতসম বৈষম্য দূর করার একমাত্র পদ্ধতিই হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ।
শিক্ষক সমাজের চাওয়া প্রধানমন্ত্রী যেন একই সাথে সকল বেসরকারি স্কুল-কলেজ জাতীয়করণের ঘোষণা দেন। শিক্ষকরা জাতি ও মানুষ গড়ার কারিগর। তাদের অবহেলা ও বঞ্চনার মধ্যে রেখে জাতির উন্নয়ন হতে পারে না।
বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে বেসরকারি শিক্ষকদের বহুবিধ বঞ্চনার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সরকার প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট শিক্ষকদের দাবি অবিলম্বে সরকারি শিক্ষকদের অনুরূপ বাড়ি ভাড়া, পূর্ণাঙ্গ উৎসব, চিকিৎসা, অবসর ভাতা ও কল্যাণ ট্রাস্টের ভাতার পরিবর্তে অবসরকালে পূর্ণ পেনশন প্রদান।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের ক’জন শিক্ষকের মন্তব্য তুলে ধরা হলো- নুর আলোম সিদ্দিকী..তিনি লিখেছেন- শিক্ষকদের যোগ্য বেতন না দিয়ে অনুদান দিয়ে অসম্মান করা হয়,উৎসব বোনাস আংশিক দেওয়া হয়, বাড়ী ভাড়া দিয়ে বস্তিতেও ঘর পাওয়া যায় না,চিকিৎসা ভাতা দিয়ে গরুর ডাক্তারও দেখানো যায় না,ঘুষ ছাড়া এম, পি, ও হয় না,সেই দেশে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করা হতভাগ্য শিক্ষক সমাজ কে নিয়ে প্রহসন নয় কি?
বিধান চন্দ্র..তার মতামত-এসব ভাল লাগে না যখন দেখি জাতির মেরুদন্ডের কারিগররা ষোলো বছর এমপিও পায় না। শুভেচ্ছা ভাল লাগে না যখন দেখি একজন শিক্ষক বাজারে গেলে মাথা নিচু করে দরদাম করে। এসব ভাল লাগে না যখন দেখি শ্বশুরবাড়ির লোকজন এলে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। তাই শুভেচ্ছা দিয়ে লজ্জা দিবেন না।এমন হাজাও শিক্ষক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তাদের হতাশা আর সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
সর্বোপরি, গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবী শিক্ষকদের। তাদের ন্যয়সঙ্গত দাবি পুরন হলে শিক্ষক সমাজ আজীবন শ্রদ্ধা অবনতচিত্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বরন করবে। যেমন স্বরণ করেছিলো তার পিতা জাতির জনক শেখ মুজিব কে যিনি এক যোগে সরকারী করণ করেচিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো।
লেখক-
অধ্যাপক সাজেদুর রহমান সাজ্জাদ
সম্পাদক,শিক্ষাবিদ,কলামিষ্ট ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
বাংলাদেশ সময়: ৭:০৫ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ০৭ অক্টোবর ২০২২
gurudaspurbarta.com | MD. Faruk Hossain